সুলেখা আক্তার শান্তা
তাহামিনা তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে নয়। তার চাওয়া-পাওয়া খুব সামান্য। সংসারী
মেয়েদের যে গুণাবলীর সবই তার মধ্যে আছে। সে খুব দায়িত্ববান নারী। শাড়ি গহনা বা
অন্য কোন শখ পুরনে স্বামীকে সে কখনো ব্যতিব্যস্ত করে না। স্বামী শাহিন স্ত্রীর
বিবেচনাবোধ দেখে বেশ ভালো বোধ করে। জীবন চলার পথে এমন স্ত্রী পেয়েছে। সে
নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করে। তাহামিনার শ্বশুরবাড়ী সকলের সঙ্গে তার খুব ভালো
সম্পর্ক। ছোট জা হেনাকে বোনের মতো স্নেহ করে। সে হেনাকে সংসারের কোন কাজ
করতে দেয় না।
হেনা বলে, তুমি সংসারের সারাক্ষণ কাজ করে যাবে আর আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব।
না, তা হবে না। আমরা মিলেমিশে সংসারের কাজ করব।
আমি যখন কাজ সামলিয়ে নিতে পারছি তখন তোর কাজ করতে হবে না। শাজাহান স্ত্রী
আর ভাবিকে উদ্দেশ্য করে পরিতৃপ্ত মুখে বলে, তোমাদের একই কথা তোমরা কেউ
কাউকে কাজ করতে দিবেনা। এ নিয়ে সারাদিন তোমাদের যত কথা।
দেখে না আপা কি বলে, কাজ করলে নাকি আমার কষ্ট হবে। কিছু করতে গেলে থামিয়ে
দেয়। বরং আমি চাই আপা কোন কাজ না করুক। তার কষ্ট লাঘব করতে চাই।
নে হয়েছে এবার থাম।
তাহামিনাকে জড়িয়ে ধরে হেনা বলে, আপা তুমি আমাদের সংসারটা কে যেভাবে
ভালোবাসার ছায়া দিয়ে আগলিয়ে রেখেছ, এই ভালোবাসার বন্ধন যেন কখনো না ছিন্ন
হয়।
হেনার ছোট বোন রেনু বলে, তোমাদের এমন গভীর আলাপে আশেপাশের কাউকে দেখার
ফুরসত নাই। আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমাকে কারো চোখেই পড়ছে না।
তাহামিনা আরে রেনু যে। যাক তুমি এসেছ ভালো হয়েছে। এখানে কিছুদিন থেকে যাবে।
না আমি আর যাচ্ছি না।
তোমাকে যেতে বললো কে থেকে যাও না।
হেনা বোনের নাক ধরে, থাকিস তোর যতদিন ইচ্ছা হয়।
রেনু বোনের বাড়ি এসেছে। আনন্দে তার সময় কাটে। প্রফুল্ল চিত্তে ঘুরে বেড়ায়। শাহিনের
ছোট ভাইয়ের শালীর সঙ্গে বেশ ভাব জমে ওঠে। রাজ্যের কথা তাদের। রাত অনেক হয়
কিন্তু তাদের আলাপ শেষ হয় না। আলাপচারিতার গভীরতা নিয়ে দু’জনের কেউ মাথা
ঘামায় না।
একদিন সকালে শাহিন নাস্তার টেবিলে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমার একটি কথা
আছে। কথার ধরনটা একটু ভিন্ন রকম। সবাই তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে।
শাহিন কোনরকম রাখঢাক না রেখে হঠাৎ বলে ফেলে। আমি রেনুকে বিয়ে করব! সবাই
চমকে তাকায়। নিশ্চুপ সকলে, কারো মুখে কোন কথা নেই। শাজাহান চেঁচিয়ে বলে,
তোমার কি মাথা ঠিক আছে?
শাহিন কঠিন গলায় উত্তর দেয়। কেন তোর কি মনে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি? আমার
জীবন চলার জন্য আমি সঠিক মানুষটাকে পেয়ে গেছি।
আমার মনে হচ্ছে তুমি এখন সুস্থ না।
তোমরা যে যাই বলো না কেনো আমি কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরবো না।
তাহমিনা স্তম্ভিত। স্বামীকে বলে, তুমি এসব কি বলছ! সন্তানের কথা একবার ভাবো?
আমি কোন ভাবাভাবির মধ্যে নেই।
হেনা বোন রেনুকে বলে, আমার ভাসুর যা বলছে তা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। আস্তে বললেও কথাটাই জোর ছিল।
এসব কি বলছিস তুই। একবার ভেবে দেখ। আমি তোর বড় বোন। সে আমার ভাসুর,
তাকে বিয়ে করবি তুই!
তুমি আমাকে বুঝাতে চাচ্ছ সে আমার অনেক বড়। এসব আমার কাছে কোনো বাধা না।
তুমি পারো বোন হয়ে বোনের সুখের জন্য একমত হতে।
ছি! আমার তোকে বোন ভাবতে ঘৃণা হয়। তুমি আমার মায়ের মতো বোনের এই সর্বনাশ
করিস না।
আমি বলি তুমি শুনো শাহিন শুধু আমার এই জনমেই না পরজনমে ও শুধুই আমার। কেউ
পারবে না আমার কাছ থেকে ওকে দূরে সরাতে। হেনা বোনের কথায় অবাক হয়। তুই
আমার ভাসুরের নাম ধরে কথা বলছিস?
শাহিন হচ্ছে আমার ভালোবাসার মানুষ। কখনো ওর নাম ধরে ডাকবো, কখনো জান,
পরান আরো অনেক কিছু বলে ডাকবো।
দুইদিনই সে তোর ভালোবাসার মানুষ হয়ে গেল। আর যার সঙ্গে বছরের পর বছর
সংসার করছে সে তার কি?
আমি ছাড়া শাহিনের ভালবাসর মানুষ অন্য আর কেউ নয়। এখন আমার হৃদয় যেমন
শাহিনকে ছাড়া কিছু বুঝে না তেমনি শাহিনের হৃদয়েও আমি ছাড়া অন্য কারো স্থান
নেই।
হায়রে ভালোবাসা। ভালোবাসার মোহতে তুই এমন অন্ধ হয়েছিস যে ভালো মন্দ বোঝার
বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিস।
সব বাধা অতিক্রম করে শাহিন আর রেনু বিয়ে করে। তাহমিনা কোনোভাবেই স্বামীর এ
বিয়ে ফেরাতে পারিনি। বিয়ের পর সতিনের অবধারিত অশান্তির জ্বালায় তাকে পুড়তে
হয়। স্বামীর অধিকার থেকে হতে হয় বঞ্চিত। শাহিনের সব বিষয় রাজত্ব করে দ্বিতীয় স্ত্রী
রেনু। রেনু উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বিয়ের পর দিন দিন স্বামীর কাছে তার অর্থ-সম্পদের চাহিদা
বেড়ে যায়। স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা চাহিদার কাছে হারিয়ে ফেলে নিজেকে। সিদ্ধান্ত নেয় সে
স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস করবে। তার স্বপ্নের জালে সে সার্থক হয়। শাহিন স্ত্রী রেনুর
আশা পূর্ণ করতে মরিয়া হয়ে পড়ে। শাহিনের বড় স্ত্রী তাহানিয়া স্বামীর এই সিদ্ধান্ত বাধা
দেয়। সন্তানের কথা একবার ভেবে দেখো। সন্তানের সামনে থেকে সন্তানের ভরণপোষণ
দেওনা দূরে গেলে তো আমাদের কোনো খোঁজ খবর রাখবে না।
শাহিন ক্ষেপে যায়। আমারটা খাচ্ছ, পড়ছো তারপরও আমার প্রতি এই অভিযোগ?
স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব পালন না করলে তো অভিযোগের সামনে দাঁড়াতেই হবে।
শাহিন পরিবারের সবার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলেও দ্বিতীয় স্ত্রী প্রতি খুবই
দায়িত্ববান। রেনু আমার কাছে তেমন কিছু আশা করেনি। সে ঢাকায় থাকবে কিন্তু এতো
বড় কোনো আশা না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঢাকায় তাকে একটি ফ্ল্যাট কিনে দেবো।
অনেক টাকার ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে আমি তোমাদের কোনো খরচ বহন করতে পারবো
না।
আপনি আমাদের ভরণপোষণ না দিয়ে ছোট বউকে ফ্ল্যাট কিনে দিবেন! কপালপোড়া কাকে
বলবো, আপনাকে নাকি সন্তানকে? সন্তানের বাবা হয়ে সন্তানের কর্তব্য পালন করছেন না!
এখন কোন নীতিকথায় আপনার চেতনা ফিরবে না।
হেনা বোনকে বলে, সংসারে যে অশান্তি লাগিয়েছিস, এই অশান্তি বন্ধ কর।
রেনু বোন হেনাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমার সংসারের আমি কি করব না করব, এ
আমার একান্ত বিষয়। তুমি এখানে কথা বাড়াবে না। আমি বুঝি আমার কি করতে হবে।
তোর আগে আমি এই সংসারে এসেছি। এখানে আমার কথা মূল্য বেশি।
তোমার মূল্য নিয়ে তুমি থাকো। আমি তো তাতে কর্তৃত্ব করছি না।
আমি তোর মত কারো অধিকার থেকে বঞ্চিত করছিনা। যা কারো দৃষ্টিকটু হতে পারে।
শোন মেয়েরা স্বামীর বাড়ি আসে স্বামীর সর্ব অধিকারে অধিকারিণী হতে। তাই আমিও
স্বামীর সর্ব অধিকারে অধিকারী হতে চাই। কিন্তু আমি চাইনা স্বামীর অধিকারের কোন
কিছু থেকে বঞ্চিত হতে। আর নিজেকে সুখী করতে হলে সবাইকে সুখী করা যায় না।
তাহলে নিজেকে সুখী করা যায় না।
সুখের তুই কী বোঝোস? অন্যের সুখ কেড়ে নিয়ে নিজেকে সুখী করিস। এই তোর বীরত্ব!
কিসে আমার বীরত্ব তা তুমি দেখতেই পাচ্ছো। আর তুমি যার পক্ষপাতী হয়ে কথা বলছ।
তার অধিকার এখন আমার হাতে। আমি চাইলে সে স্বামীর অধিকারে অধিকারীনি হতে
পারবে আর নয় তো না।
তোর কাছে থেকে সে নেবে স্বামীর অধিকার! এমন নারী সে নয়। তোর ক্ষমতা নিয়ে তুই
পড়ে থাক।
শাহিন ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে। স্ত্রী রেনুকে নিয়ে সে ঢাকায় বসবাস করে। প্রথম স্ত্রী তাহামিনা
ও তার সন্তানদের সে ভুলে যায়। তাহামিনা সন্তানকে নিয়ে কি করবে সে ভেবে পায়না।
দেবর শাহজাহানের অবস্থা তেমন ভালো না। তাদের ভরণপোষণ দেবার মত সামর্থ্য তার
নেই। তাহমিনা ভাবে তাকে নিজের একটা কিছু করতে হবে। নিরুপায় হয়ে সে সন্তানদের
নিয়ে ঢাকায় আসে। জমানো কিছু টাকা ছিল। তাদিয়ে কর্ম হিসেবে বেছে নেয় কাপড়ের
ব্যবসা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সে শাড়ি বিক্রি করে। ভাগ্য প্রসন্ন কিছু দিনেই জমে ওঠে
ব্যবসা। কাপড় বিক্রিতে তার উপার্জন বেশ ভালো হতে থাকে। সে সান্তনা পায়, যাক
ছেলে-মেয়েদের মুখে তো আহার তুলে দিতে পারছি। সে এখন স্বামীর কাছ থেকে কোন
কিছু পাওয়ার আশা করে না। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত সে। এক এক করে তিন
মেয়ের বিয়ে দেয়। এক ছেলে তাকেও বিয়ে করায়। তাহামিনা ছেলে-মেয়ে সবাইকে নিয়ে
সুখে শান্তিতে সংসার করে।
রেনু জানতে পারে তাহমিনা ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিয়ে খুব ভালো আছে। তাতে হিংসার
আগুনে জ্বলে সে। সতিনের সুখ সহ্য হয়না তার। সে প্রকৌশল খাটায়। স্বামীকে দিয়ে বড়
স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করায়। শাহিন ছোট স্ত্রীর কথা মতো বড় স্ত্রী ও তার সন্তানের সঙ্গে
যোগাযোগ করে। ছোট মেয়ে রিফা ও তার স্বামী তৌহিদের কাছে ব্যবসার লোভ দেখিয়ে
টাকা চায়। তৌহিদকে বলে, তোমাকে আমি ভালো ব্যবসা ধরিয়ে দেবো। তাতে দূরত্ব
তোমার ব্যবসা থেকে বেশি টাকা লাভ আসবে। তৌহিদ শ্বশুরের মিষ্টি কথায় ব্যবসায়
টাকা দিতে সম্মত হয়। তাহমিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে স্বামী তার ভুল থেকে অবসর
হয়েছে। সে এখন ছেলে মেয়ের কথা ভাবে। স্বামীর প্রতি তার সব অভিযোগ শেষ হয়ে
যায়।
শাহিন ব্যবসার নাম করে মেয়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পর যোগাযোগ বন্ধ করে
দেয়। দিন, মাস, বছর যায় বড় স্ত্রি ও তার সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ আর করে না
শাহিন। তৌহিদ শ্বশুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে স্ত্রী রিফাকে বলে, এখন আমার
টাকার কি উপায় হবে? তৌহিদ জানে এতে তার স্ত্রীর রিফার দোষ নেই। তৌহিদের বাবা
বোরহান আহাম্মেদ ও মা জোলি ছেলের টাকার জন্য স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে পুত্রবধূ
রিফাকে খুব বকাঝকা করে। আমরা ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি তোমাদের পরিবার কাছ
থেকে কোন কিছু নেইনি। উল্টো তোমার বাবা আমাদের ছেলের কাছ থেকে ব্যবসার নাম
করে টাকা নিয়েছে। এখন দেওয়ার কোন নাম নেই। শান্তির সংসারে শুরু হয় অশান্তি। এই
টাকার জন্য আমরা ছেলেকে অন্য জায়গায় বিয়ে করাব। শ্বশুর শাশুড়ি টাকার জন্য
পুত্রবধূ রিফাকে ভীষণ অশান্তি করে। কোনভাবেই তাদের মুখ বন্ধ হয় না। একপর্যায়ে
রিফা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার করার চেষ্টা করে। শ্বশুর বোরহান আহাম্মেদ
শাশুড়ি জোলি টের পেয়ে তাতে বাধা দেয়। তারা বলে, বৌমা তোমাকে আর কখনোই
কিছু বলব না। তাও তুমি এমন কাজ করোনা। আমরা আর কখনো তোমাকে টাকার
জন্য কিছু বলবো না। আমরা টাকা চাই না, আমরা চাই আমাদের বউ মাকে। যে টাকার
জন্য আমাদের বউমা জীবনের মায় ত্যাগ করতে বসেছিল। তোমার বাবার কাছ থেকে
সে টাকা আমরা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলাম। টাকার চেয়ে মায়া মমতা ভালোবাসা
অনেক বড়। তাহমিনা মেয়ের এমন খবর পেয়ে ছুটে আসে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভাবে
স্বামীর নিষ্ঠুরতার কথা। সন্তানের সুখ দিতে পারলে না, কিন্তু সন্তানের সুখে পথের কাঁটা
হয়ে দাঁড়ালে। সবচেয়ে আপনজন হলেও অর্থ-সম্পদ, মোহ মানুষকে কিভাবে অমানুষে
পরিণত করে। সুখের জন্য যারা অন্যের সুখ বিনষ্ট করে জানিনা জীবনে তারা কতটা সুখী
হতে পারে।
© স্বর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
All Right Reserve Daily Somoyer Barta © 2020.